ভালো জিনিস নাকি সবসময় জোড়ায় জোড়ায় আসে — এটা তো আগেই শুনেছ, তাই না? ধরো, এক থালায় দুটো গরম গরম বেগুনি, কিংবা একসাথে দুজন বন্ধু মিলে হাততালি — “দারুণ করেছো!” আর তার চেয়েও মজার, সবচেয়ে দারুণ দুই-এক প্যাক ডিল কী জানো? যমজ!
তুমি নিশ্চয়ই যমজ শিশুদের কথা জানো — যারা একসাথে জন্মায়। কিন্তু সব যমজ একরকম হয় না। সবচেয়ে পরিচিত দুই ধরনের যমজ হলো ভ্রাতৃপ্রতিম (যারা দেখতে একরকম না, আলাদা আলাদা ডিম থেকে তৈরি হয়) আর অভিন্ন যমজ (যারা দেখতে হুবহু এক, একটাই ডিম ভাগ হয়ে জন্মায়)।মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে যমজ নিয়ে মুগ্ধ। বিজ্ঞানীরা যমজ কীভাবে হয় — মানে ডিম বিভক্ত হয়ে কেমন করে দুটো সন্তান হয়
যমজ সন্তান কী?
আমাদের চারপাশে মাঝে মাঝে আমরা এমন ভাই-বোনদের দেখি যারা দেখতে হুবহু একরকম, কিংবা একই সাথে জন্মেছে কিন্তু একে অপরের থেকে পুরো আলাদা! তখন অনেকেই বলে, “ওরা যমজ!” কিন্তু আসলে যমজ সন্তান কী? তারা কেমন করে হয়? এবং সব যমজ কি দেখতে একরকম? এই প্রবন্ধে আমরা জানব যমজ সন্তান সম্পর্কে খুব সহজভাবে।
যমজ সন্তান কিভাবে হয়?
একজন নারীর শরীরে মাসে একবার একটি (বা একাধিক) ডিম্বাণু (Egg) নিঃসরণ হয়। যদি সেই ডিম্বাণু কোনো পুরুষের শুক্রাণুর (Sperm) সঙ্গে মিলিত হয়, তাহলে একটি নিষিক্ত ডিম্বাণু তৈরি হয়, যাকে জাইগোট (Zygote) বলা হয়। এই জাইগোট ধীরে ধীরে বিভাজিত হয়ে একটি শিশুর রূপ নেয়।
তবে কখনো কখনো এমন ঘটে, যখন একসাথে দুইটি ডিম্বাণু নিষিক্ত হয় বা একটি জাইগোট নিজে থেকেই ভাগ হয়ে যায়। তখনই যমজ সন্তানের সৃষ্টি হয়।
ভিন্ন রকম যমজ (Fraternal Twins)
ভিন্ন রকম যমজ তখনই হয়, যখন দুইটি আলাদা ডিম্বাণু একসাথে মুক্তি পায় এবং দুইটি আলাদা শুক্রাণু সেগুলিকে নিষিক্ত করে। তখন দুইটি আলাদা জাইগোট তৈরি হয় এবং ফলে তৈরি হয় দুইটি আলাদা শিশু।
এই ধরণের যমজকে ডাইজাইগোটিক (Dizygotic) যমজ বলা হয়। তারা দেখতে একে অপরের মতো না হলেও, ঠিক যেমন সাধারণ ভাই-বোন হয়, তেমনই হয়।
- তারা ছেলে-মেয়ে দুই রকমই হতে পারে – দুই মেয়ে, দুই ছেলে, বা একজন ছেলে ও একজন মেয়ে।
- তাদের জিনগত মিল সাধারণ ভাইবোনদের মতোই, কারণ তাদের উৎস আলাদা।
- তারা সাধারণত দুইটি আলাদা অম্বল বা প্ল্যাসেন্টা নিয়ে জন্মায়, যদিও কখনো কখনো এই দুটি প্ল্যাসেন্টা একসাথে জোড়া লেগে যেতে পারে।
একই রকম যমজ (Identical Twins)
এই ধরণের যমজ হয় যখন একটি ডিম্বাণু ও একটি শুক্রাণু মিলিত হয়ে একটি জাইগোট তৈরি করে, কিন্তু পরে সেই জাইগোট নিজে থেকেই দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। ফলে দুটি সন্তান একই জিন (DNA) থেকে তৈরি হয় এবং দেখতে প্রায় একরকম হয়।
এই যমজদের বলা হয় মনোজাইগোটিক (Monozygotic) যমজ।
- তারা সাধারণত একই লিঙ্গের হয় – দুজনই ছেলে বা দুজনই মেয়ে।
- দেখতে প্রায় হুবহু এক, কিন্তু জীবনযাপনের পার্থক্যের কারণে তাদের মধ্যে ছোটখাটো চেহারার পার্থক্য হতে পারে – যেমন একজন রোদে বেশি থাকে, কেউ খেলাধুলা করে বেশি, কেউ হয়তো অসুস্থ থাকে ইত্যাদি।
- তাদের একটি বা দুটি প্ল্যাসেন্টা থাকতে পারে, এটা নির্ভর করে কখন জাইগোট ভাগ হয়েছে।
যমজ সন্তানের বিস্তার
গবেষণায় দেখা গেছে, ভিন্ন রকম যমজ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশি দেখা যায়, বিশেষ করে আফ্রিকা ও উত্তর আমেরিকায়। নাইজেরিয়ার Igbo-Ora নামক এক এলাকায় সবচেয়ে বেশি যমজ জন্ম হয়—প্রতি ১,০০০ জনে প্রায় ৪৫ জন।
অন্যদিকে, একই রকম যমজ তুলনামূলকভাবে কম হয়—প্রতি ১,০০০ জন্মে প্রায় ৩ থেকে ৫টি।
যমজ গর্ভাবস্থা: কিছু বাড়তি যত্ন প্রয়োজন
যমজ গর্ভাবস্থা সাধারণ একক গর্ভাবস্থার চেয়ে কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। বিশেষ করে, যদি দুই শিশুর একই প্ল্যাসেন্টা হয়, এবং তারা রক্ত শেয়ার করে, তাহলে Twin-to-Twin Transfusion Syndrome নামে একটি জটিলতা হতে পারে।
এই কারণেই যমজ গর্ভাবস্থায় বাড়তি পরিশ্রম, নিয়মিত পরীক্ষা ও চিকিৎসকের তত্ত্বাবধান জরুরি।
দুর্লভ কিছু যমজ ধরন
যমজ সাধারণত দুই প্রকার হলেও, বিজ্ঞানীরা আরও কিছু বিরল ধরণের যমজ চিহ্নিত করেছেন:
- জোড়া যমজ (Conjoined Twins): একটি জাইগোট সম্পূর্ণভাবে ভাগ না হয়ে দুই সন্তান একসাথে লেগে থাকে। তারা শরীরের বিভিন্ন অংশে যুক্ত থাকতে পারে।
- প্যারাসাইটিক টুইন (Parasitic Twins): একজন শিশু সম্পূর্ণ তৈরি হয়, কিন্তু অন্যটি অপূর্ণ থাকে, এবং প্রথমজনের শরীরেই লেগে থাকে।
- ভিন্ন বয়সের যমজ (Superfetation): গর্ভাবস্থায় দ্বিতীয়বার ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়ে দুইটি ভিন্ন সময়ে গঠিত শিশু একসাথে জন্ম নেয়। বিশ্বে এ পর্যন্ত এমন ঘটনা মাত্র হাতে গোনা কয়েকবার ঘটেছে।
- দুই বাবার যমজ (Different Fathers): যদি ভিন্ন সময়ে দুই শুক্রাণু দুটি আলাদা ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করে, তবে যমজ সন্তানের বাবা আলাদা হতে পারে (খুবই বিরল)।
- আধা-একই রকম যমজ (Half-identical Twins): একটি ডিম্বাণু যদি দুই শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয় এবং পরে ভাগ হয়, তাহলে এমন যমজ হতে পারে। এটা এতটাই বিরল যে পৃথিবীতে মাত্র দুটি ঘটনা পাওয়া গেছে।
শেষ কথা
যমজ সন্তান একটি প্রাকৃতিক বিস্ময়। এদের জন্মের পেছনে রয়েছে নানা বৈজ্ঞানিক কারণ ও প্রক্রিয়া। কেউ হয় দেখতে হুবহু একরকম, আবার কেউ হয় সম্পূর্ণ আলাদা।
যমজ সন্তানের মাঝে শুধু দেখতে নয়, বরং মনের বন্ধনও থাকে গভীর। তাদের নিয়ে গবেষণা এখনও চলছে, আর আমাদের জানার ভাণ্ডার প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
Leave feedback about this