June 21, 2025
Action

ঘুমিয়ে পড়ার আগে শরীর হঠাৎ কেঁপে ওঠে কেন?

যখন আমরা ঘুমিয়ে পড়ি, তখন হঠাৎ কিছু ঝাঁকুনি আমাদের মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে আসে, যার ফলে হাত-পা কেঁপে ওঠে। কেউ এতে চমকে ওঠে, কেউ আবার লজ্জা পায়। এই ঝাঁকুনিগুলোর নাম হিপনিক জার্কস (Hypnic Jerks)। এটি হচ্ছে ঘুম ও জাগরণের মাঝখানে মস্তিষ্কে চলা এক লুকানো লড়াইয়ের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।

সাধারণভাবে আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি, তখন শরীর এক ধরনের প্যারালাইসিস বা অসাড় অবস্থায় থাকে। এমনকি সবচেয়ে জীবন্ত স্বপ্ন দেখার সময়ও আমাদের পেশিগুলো শান্ত থাকে, বাইরের দিকে খুব একটা নড়াচড়া করে না। বাইরের জগতের ঘটনাগুলো সাধারণত ঘুমের ওপর তেমন প্রভাব ফেলে না – যদিও এটা চেষ্টা না করাই ভালো, তবুও কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, যদি কারও চোখ খোলা রেখে ঘুমানো হয় এবং তার সামনে আলো ফ্ল্যাশ করা হয়, তাহলে তাও তার স্বপ্নে তেমন প্রভাব ফেলে না।

তবে স্বপ্ন দেখার সময় বাইরের জগতের সঙ্গে সংযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয় না। ঘুমন্ত মস্তিষ্ক থেকে দু’ধরনের নড়াচড়া বাইরের জগতে পৌঁছায়, এবং এই দুটো ঘটনা আমাদের ভেতরের ভিন্ন ভিন্ন গল্প বলে।

মস্তিষ্কের লড়াই

ঘুমের সময় আমাদের শরীর যেসব নড়াচড়া করে, তার মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ হলো র‌্যাপিড আই মুভমেন্টস (Rapid Eye Movements) – মানে চোখের দ্রুত নড়াচড়া। যখন আমরা স্বপ্ন দেখি, আমাদের চোখগুলো সেই স্বপ্ন অনুযায়ী নড়ে। যেমন, যদি আমরা স্বপ্নে দেখি টেনিস খেলা দেখছি, তাহলে চোখগুলো ডান-বাম দিকে নড়ে – একেকটা ভলি অনুযায়ী। এই চোখের নড়াচড়াগুলো স্বপ্নের জগত থেকে পালিয়ে এসে বাস্তব জগতে পৌঁছায়। কারো ঘুমন্ত অবস্থায় চোখ নড়াচড়া করলে বুঝতে পারা যায় সে স্বপ্ন দেখছে।

হিপনিক জার্কস কিন্তু ভিন্ন ধরনের। এগুলো সবচেয়ে বেশি দেখা যায় শিশুদের মধ্যে, যখন তাদের স্বপ্নগুলো সাধারণ ও সহজ হয় এবং স্বপ্নের সঙ্গে শরীরের আচরণের মিল থাকে না – যেমন, কেউ স্বপ্নে সাইকেল চালালেও বাস্তবে তার পা গোল করে ঘোরে না। বরং, হিপনিক জার্কস ইঙ্গিত দেয় যে ঘুমের সময় শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া শুরু হলেও, মোটর সিস্টেম (যা আমাদের শরীরের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করে) তখনও কিছুটা কাজ করতে পারে।

আমাদের মস্তিষ্কে ঘুম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য কোনো একটি সহজ ON/OFF সুইচ নেই – মানে রাত হলে চালু আর দিন হলে বন্ধ – বরং সেখানে দুইটি বিপরীত শক্তি প্রতিদিন একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করে, এবং প্রতিদিন ঘুম ও জাগরণের মধ্য দিয়ে এক ধরণের ‘নৃত্য’ চলে, যেখানে এক পক্ষকে অন্য পক্ষের কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণ কেড়ে নিতে হয়।

মস্তিষ্কের গভীরে, কর্টেক্সের (যা মানুষের মস্তিষ্কের সবচেয়ে উন্নত অংশ) নিচে একটি স্নায়ুকোষের জাল রয়েছে, যাকে বলা হয় রেটিকুলার অ্যাকটিভেটিং সিস্টেম (Reticular Activating System) বা RAS। এটি মস্তিষ্কের সেই অংশের মধ্যে থাকে, যেগুলো আমাদের শরীরের প্রাথমিক কাজ যেমন শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করে। যখন এই RAS সক্রিয় থাকে, তখন আমরা সজাগ ও উত্তেজিত অনুভব করি – অর্থাৎ আমরা জেগে থাকি।

এর বিপরীত দিকের কাজ করে ভেন্ট্রোলেটারাল প্রি-অপটিক নিউক্লিয়াস (Ventrolateral Preoptic Nucleus), সংক্ষেপে যাকে বলা হয় VLPO। ‘ভেন্ট্রোলেটারাল’ মানে এটি মস্তিষ্কের নিচের ও পাশের দিকে অবস্থিত, আর ‘প্রি-অপটিক’ মানে এটি চোখের স্নায়ুগুলো যেখানে ক্রস করে তার ঠিক আগে থাকে। VLPO আমাদের ঘুমের অনুভূতি সৃষ্টি করে। এটি চোখের স্নায়ুর কাছে অবস্থান করায় দিনের আলো ও অন্ধকার সম্পর্কে তথ্য পায় এবং সেই অনুযায়ী ঘুমের সময় নিয়ন্ত্রণ করে।

যখন আমাদের মন বাইরের জগৎ বোঝার কাজ থেকে সরে আসে এবং নিজের কল্পনায় ডুবে যেতে শুরু করে, তখন এই RAS ও VLPO-র মধ্যে যুদ্ধ VLPO-র দিকে ঝুঁকে পড়ে – অর্থাৎ আমরা ঘুমিয়ে পড়ি।

এই সময় স্লিপ প্যারালাইসিস (ঘুমের সময় শরীর অচল হয়ে যাওয়া) শুরু হয়। তবে এই সময় শরীর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ হারায় না। দিনের সময়ের শক্তি তখনও কিছুটা রয়ে যায়, যার ফলে শরীর থেকে হঠাৎ করে কিছু এলোমেলো ঝাঁকুনি দেখা দেয়। এই ঝাঁকুনিই হচ্ছে হিপনিক জার্কস (Hypnic Jerks) – ঘুমাতে যাওয়ার সময় শরীরের হঠাৎ কাঁপুনি, যা দিনের শেষ মুহূর্তের জাগ্রত মস্তিষ্কের শেষ চিহ্ন।

অনেকে বলেন, এই ঝাঁকুনি ঘটা মুহূর্তে তারা স্বপ্নে দেখে পড়ে যাচ্ছেন বা হোঁচট খাচ্ছেন। এটাকে বলা হয় ড্রিম ইনকরপোরেশন (dream incorporation), যেখানে বাইরের কোনো বাস্তব জিনিস – যেমন অ্যালার্ম – স্বপ্নের ভেতরে ঢুকে পড়ে। এতে বোঝা যায়, আমাদের মস্তিষ্ক কতো দক্ষভাবে একটা কাহিনি বানাতে পারে। কারণ স্বপ্ন দেখার সময় আমাদের পরিকল্পনা ও যুক্তির অংশগুলো চাপা পড়ে যায়, ফলে মন স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায় – একেবারে যেমন একজন জ্যাজ সংগীতশিল্পী তার সঙ্গীদের অনুপ্রেরণায় তৎক্ষণাৎ নতুন কিছু বাজিয়ে ফেলে।

যখন এই হিপনিক জার্কস ঘটে, তখন ঘুম ও জাগরণের মাঝখানে থাকা মন নিজেই বদলে যেতে থাকে। জেগে থাকতে হলে আমাদের বাইরের জগৎ বোঝার দরকার হয়, আর স্বপ্নে আমরা নিজের মনের কাজ বোঝার চেষ্টা করি। ঘুমে যাওয়ার সময় বাইরের জগৎ থেকে মন অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও, হিপনিক জার্কস যেহেতু আমাদের নিজের শরীরের গতি, তাই মস্তিষ্ক এগুলোকে লক্ষ্য করে এবং সেগুলো স্বপ্নের মধ্যে নিয়ে আসে।

এইভাবে ঘুমের মধ্যে দুটো ভিন্ন রকমের নড়াচড়ার মধ্যে একটা সুন্দর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। র‍্যাপিড আই মুভমেন্ট (Rapid Eye Movement বা REM) হলো এমন কিছু যা স্বপ্নের সময় বাইরে থেকে দেখা যায়। আর হিপনিক জার্কস হলো এমন কিছু যা জাগরণ থেকে স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে পড়ে।

Leave feedback about this

  • Quality
  • Price
  • Service

PROS

+
Add Field

CONS

+
Add Field
Choose Image
Choose Video