June 21, 2025
Animal

ঠান্ডা রক্তের প্রাণী

প্রাণীদের বিভিন্নভাবে শ্রেণিবিন্যাস করা যায়—যেমন প্রজাতি, পরিবার, কোন অঞ্চলে তারা থাকে, কী খায়, বা কোথায় বসবাস করে এসব ভিত্তিতে। তবে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হচ্ছে তাদের দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাণীরা মূলত দুই ভাগে বিভক্ত—ঠান্ডা রক্তের (cold-blooded) এবং গরম রক্তের (warm-blooded) প্রাণী।

কিন্তু “ঠান্ডা রক্তের” বলতে আসলে কী বোঝায়? আর এই প্রাণীরা গরম রক্তের প্রাণীদের থেকে কীভাবে আলাদা?

ঠান্ডা রক্তের প্রাণী বলতে কী বোঝায়?
ঠান্ডা রক্তের প্রাণীকে ectothermic বা poikilothermic প্রাণীও বলা হয়। এদের দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা খুব কম বা একেবারেই থাকে না। তারা নিজেরা শরীরের ভেতর থেকে তাপ উৎপন্ন করতে পারে না, তাই তাদের শরীরের তাপমাত্রা আশেপাশের পরিবেশের উপর নির্ভর করে। অর্থাৎ, ঠান্ডা রক্তের প্রাণী যদি গরম হতে চায়, তাহলে তাকে এমন পরিবেশে যেতে হয় যেখানে তাপ বেশি।

উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক: গরমের দিনে টিকটিকি বা গিরগিটি যখন পাথরের ওপর রোদ পোহায়, তখন আসলে সে সূর্যের তাপ ব্যবহার করে নিজের শরীর গরম করছে। এতে তার শক্তি বাড়ে, শরীরের কাজ স্বাভাবিকভাবে চালু থাকে, যেমন—হজম, চলাফেরা, শিকার করা ইত্যাদি। আবার বেশি গরম বা ঠান্ডা এড়াতে এরা মাটি খুঁড়ে গর্তে ঢুকে পড়ে বা পানিতে ডুবে যায়।

তবে “ঠান্ডা রক্তের” মানে এই না যে তাদের রক্ত ছুঁয়ে ঠান্ডা লাগে। তাদের দেহের তাপমাত্রাও উষ্ণ থাকতে পারে, কিন্তু তা গরম রক্তের প্রাণীদের তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে বা পরিবেশ অনুযায়ী উঠানামা করে।

ঠান্ডা রক্তের ও গরম রক্তের প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য কী?
ঠান্ডা রক্তের প্রাণী ও গরম রক্তের প্রাণীর মধ্যে তিনটি বড় পার্থক্য রয়েছে। চলুন, সেগুলো সহজভাবে জেনে নেই।

১. ঠান্ডা রক্তের প্রাণীরা 

ঠান্ডা রক্তের প্রাণীরা নিজের শরীরের তাপমাত্রা নিজেরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এদের শরীরের তাপমাত্রা আশেপাশের পরিবেশের উপর নির্ভর করে।
যেমন, যখন তারা রোদে বসে থাকে, তখন সূর্যের তাপে শরীর গরম হয়। আবার ছায়ায় বা গর্তে গেলে শরীর ঠান্ডা হয়।

কিছু ঠান্ডা রক্তের প্রাণী তাদের দেহের কার্যকলাপ (metabolism) ধীরে চালায়, বিশেষ করে ঠান্ডা সময়ে। যেমন—অনেক সাপ, টিকটিকি, বা পোকামাকড় শীতকালে একেবারে ধীরে চলতে থাকে বা ঘুমের মতো একটা অবস্থা (যাকে diapause বা torpor বলে) নিয়ে নেয়। এটা অনেকটা হাইবারনেশনের মতো।

অন্যদিকে, গরম রক্তের প্রাণীরা thermoregulator, অর্থাৎ তারা তাদের দেহের তাপমাত্রা একমাত্রা (stable) রাখে, বাইরে যত গরম বা ঠান্ডাই থাকুক না কেন।
তারা তাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা কাজ করে—যেমন ঠান্ডায় কাঁপে (shivering) যাতে শরীর গরম হয়, আর গরমে হাঁপায় বা ঘামায় যাতে শরীর ঠান্ডা হয়।

২. ঠান্ডা রক্তের প্রাণীদের দেহের তাপমাত্রার ওঠানামা বেশি হয়

ঠান্ডা রক্তের প্রাণীরা অনেক বেশি তাপমাত্রার সীমার মধ্যে টিকে থাকতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, একটি নীল জিভওয়ালা টিকটিকির (blue-tongued lizard) দেহের তাপমাত্রা ৩০°C থেকে ৩৭°C (৮৬°F থেকে ৯৮.৬°F) এর মধ্যে উঠানামা করলেও সে ঠিকঠাক কাজ করতে পারে।

অন্যদিকে, মানুষের শরীরের তাপমাত্রা সাধারণত ৩৬.১°C থেকে ৩৭.২°C (৯৭°F থেকে ৯৯°F) এর মধ্যেই থাকে। এর চেয়ে বেশি হলে শরীর খারাপ হয়ে যেতে পারে—শরীরের এনজাইম নষ্ট হয়ে যায়, আর অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তেমনি অনেক কমে গেলেও শরীর সঠিকভাবে কাজ করা বন্ধ করে দেয়।

৩. ঠান্ডা রক্তের প্রাণীদের শক্তির চাহিদা কম

ঠান্ডা রক্তের প্রাণীদের দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে বাইরে থেকে তাপ নেয়, তাই তাদের শক্তি বা খাবারের চাহিদা অনেক কম। ঠান্ডা পড়লে তারা কম নড়াচড়া করে, যাতে শক্তি বাঁচে এবং পরিস্থিতি ভালো না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে।

অন্যদিকে, গরম রক্তের প্রাণীদের অনেক বেশি শক্তি দরকার হয় কারণ তাদের শরীর সব সময় একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় রাখতে হয়, যা অনেক বেশি শক্তি খরচ করে। তাই এরা বেশি খায় এবং বেশি সক্রিয় থাকে, যেকোনো আবহাওয়াতেও।

কোন কোন প্রাণী ঠান্ডা রক্তের?
সবচেয়ে পরিচিত কিছু ঠান্ডা রক্তের প্রাণীর মধ্যে রয়েছে — মাছ, কুমির, হাঙর, কচ্ছপ, সরীসৃপ (যেমন সাপ ও টিকটিকি), পোকামাকড়, ব্যাঙ এবং কেঁচো ব্যাঙ (toad)।

এই ঠান্ডা রক্তের প্রাণীরা অনেক রকমের পরিবেশে বসবাস করে এবং এদের মধ্যে বৈচিত্র্য অনেক বেশি। তবে গরম রক্তের প্রাণীদের তুলনায় এদের বিস্তার (যেখানে যেখানে পাওয়া যায়) কিছুটা কম।

মাছ কি ঠান্ডা রক্তের প্রাণী?

হ্যাঁ, বেশিরভাগ মাছই ঠান্ডা রক্তের। তাদের শরীরের তাপমাত্রা নির্ভর করে তারা কোন পানিতে বাস করে এবং সেই পানির তাপমাত্রা কত।
তারা যদি শরীর গরম করতে চায়, তাহলে পানির উপরিভাগে উঠে আসে; আর শরীর ঠান্ডা করতে চাইলে গভীরে ডুব দেয়।

তবে কিছু ব্যতিক্রম আছে। বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি ওপা মাছ (Opah বা Moonfish) নামের একটি গরম রক্তের মাছ আবিষ্কার করেছেন। যদিও এর শরীরের তাপমাত্রা পাখি বা স্তন্যপায়ীদের মতো বেশি না, তবুও এর রক্ত গরম এবং শরীর জুড়ে ঘোরে।
এছাড়া টুনা মাছ এবং তলোয়ার মাছ (Swordfish)-ও গরম রক্তের মাছের তালিকায় পড়ে।

শার্ক কি ঠান্ডা রক্তের প্রাণী?

হ্যাঁ, প্রায় সব শার্কই ঠান্ডা রক্তের। তবে Lamnidae পরিবারে থাকা পাঁচটি শার্ক (যেমন গ্রেট হোয়াইট শার্ক) গরম রক্তের।
বাকি শার্কদের শরীরের তাপমাত্রা চারপাশের পানির উপর নির্ভর করে। গরম পানিতে এরা গরম হয়, ঠান্ডা পানিতে ঠান্ডা।

শার্করা পানির স্রোত ব্যবহার করে শরীর গরম বা ঠান্ডা রাখে। ঠান্ডা পানিতে শক্তি বাঁচাতে ধীরে সাঁতার কাটে, আর শীতে উষ্ণ জায়গায় চলে যায়।

শার্কদের মাথায় একটি বিশেষ অঙ্গ থাকে—Ampullae of Lorenzini, যা পানি ও তাপমাত্রার পরিবর্তন টের পায়। এর মাধ্যমে তারা বুঝতে পারে কবে কোথায় গেলে শরীরের তাপ ঠিক থাকবে। তাই শার্করা পৃথিবীর প্রায় সব জায়গায়—উত্তর মেরু থেকে শুরু করে গরম প্রবাল দ্বীপ পর্যন্ত—বাস করতে পারে।

ব্যাঙ কি ঠান্ডা রক্তের প্রাণী?

হ্যাঁ, ব্যাঙ ঠান্ডা রক্তের প্রাণী। আর সব উভচর প্রাণী যেমন কেঁচো ব্যাঙ (toad), সালামান্ডার, নিউট—সবই ঠান্ডা রক্তের।

বিশ্বে ৮,০০০-রও বেশি উভচর প্রজাতি আছে, যাদের সবার দেহের তাপমাত্রা আশেপাশের পরিবেশের উপর নির্ভর করে।

উড ফ্রগ (Wood frog) নামে এক ব্যাঙ প্রজাতি আছে যা শীতে জমে যায়! তার শরীরের ভেতর বরফ জমে যায়, হৃদস্পন্দন ও শ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। তবে সে শরীরে একধরনের “অ্যান্টিফ্রিজ” জাতীয় পদার্থ তৈরি করে, যা কোষের ভেতরে বরফ জমতে দেয় না। শীত চলে গেলে আবার সে বেঁচে ওঠে।

টিকটিকি কি ঠান্ডা রক্তের প্রাণী?

হ্যাঁ, টিকটিকি সরীসৃপ শ্রেণির প্রাণী, তাই তারা ঠান্ডা রক্তের। এর মধ্যে কমোডো ড্রাগন, মনিটর লিজার্ড, গেকো ইত্যাদি সবই পড়ে।

টিকটিকি রোদে পাথরের ওপর বসে গায়ে রোদ খায়। এতে সূর্য ও পাথরের তাপ শরীরে ঢুকে গরম হয়। তারা শরীর চ্যাপ্টা করে দেয় যাতে বেশি অংশ রোদের সংস্পর্শে আসে।
ঠান্ডা লাগলে তারা ছায়ায় চলে যায় বা গর্তে ঢুকে পড়ে।
কিছু টিকটিকি আবার শরীরের রং পাল্টে সূর্য থেকে আসা আলো প্রতিফলিত করে শরীর ঠান্ডা রাখে।

অ্যলিগেটর কি ঠান্ডা রক্তের প্রাণী?

হ্যাঁ, অ্যলিগেটরও একটি সরীসৃপ, তাই এটি ঠান্ডা রক্তের। এদের আত্মীয় কুমির (Crocodile)-ও একই রকম।

এরা রোদ পোহাতে পছন্দ করে, এজন্য নদীর ধারে পাথরের ওপর পড়ে থাকতে দেখা যায়।
তারা মাটিতে গর্ত খুঁড়ে গরম থাকার জন্য আশ্রয় তৈরি করে।

মৌমাছি কি ঠান্ডা রক্তের প্রাণী?

হ্যাঁ, সব পোকামাকড়ের মতো মৌমাছিও ঠান্ডা রক্তের প্রাণী।

ঠান্ডা থেকে রক্ষা পেতে, মৌমাছিরা তাদের ছাঁচ (hive) গরম রাখতে আশপাশের ফাঁক বন্ধ করে ফেলে propolis দিয়ে—এটি গাছের কুঁড়ি থেকে সংগ্রহ করা আঠার মতো পদার্থ।
তারা একজোট হয়ে গাদাগাদি করে দাঁড়ায় যাতে শরীরের তাপ ছড়িয়ে গরম থাকে।
গরমে মৌমাছিরা পানি এনে, মুখ দিয়ে বাতাস বইয়ে ছাঁচ ঠান্ডা করে।

সব অমেরুদণ্ডী প্রাণী (যেমন মাকড়সা) ঠান্ডা রক্তের। মাকড়সারা গরমকালে সূর্য মুখী জাল তৈরি করে আর শীতে গরম ফাটলে বা কোণে লুকিয়ে থাকে।

কচ্ছপ কি ঠান্ডা রক্তের প্রাণী?

হ্যাঁ, কচ্ছপ (turtle) এবং কাঠের কচ্ছপ (tortoise) — দুটোই ঠান্ডা রক্তের প্রাণী।
তারা নিজের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, তাই আশেপাশের পরিবেশের উপর নির্ভর করে গরম বা ঠান্ডা হয়।

যদি তারা বেশি ঠান্ডা হয়ে যায়, তাহলে তাদের শরীর “কোল্ড স্টানড” (cold stunned) হয়ে পড়ে—মানে তারা খুব দুর্বল হয়ে যায় এবং আর ঠিকভাবে সাঁতার কাটতে পারে না। তখন তারা পানির উপরে ভেসে ওঠে, সহজে শিকার হয়ে যায় বা নৌকা ধাক্কা খেতে পারে। এমনকি, অতিরিক্ত ঠান্ডায় তারা মারা পর্যন্ত যেতে পারে।

সাপ কি ঠান্ডা রক্তের প্রাণী?

হ্যাঁ, সাপ ঠান্ডা রক্তের প্রাণী। তারা শরীর গরম রাখার জন্য পুরোপুরি পরিবেশের উপর নির্ভরশীল।

এই কারণেই, আমাজন জঙ্গলে প্রচুর সাপ পাওয়া যায় (কারণ ওখানে গরম), আর আন্টার্কটিকা, আইসল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, গ্রিনল্যান্ড, এবং নিউজিল্যান্ডে কোনো সাপ পাওয়া যায় না—ওখানকার আবহাওয়া সাপের জন্য খুব বেশি ঠান্ডা।

যেসব সাপ শীতপ্রধান অঞ্চলে বাস করে, সেগুলো শীতে ব্রুমেশন (brumation)-এ যায়।
এটা অনেকটা হাইবারনেশনের (ঘুমিয়ে থাকা) মতো, তবে একেবারে ঘুমিয়ে পড়ে না। এ সময় তারা অনেকটা সময় বিশ্রামে থাকে, মাঝে মাঝে পানি খেতে বা রোদ পোহাতে বের হয়। তাপমাত্রা একটু বাড়লে তারা বাইরে বের হয়, আবার ঠান্ডা পড়লে ফিরে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে।

ঠান্ডা রক্তের প্রাণী বলতে কী বোঝায়?

ঠান্ডা রক্তের প্রাণীরা প্রকৃতির বৈচিত্র্যের এক দারুণ উদাহরণ।
সরীসৃপ, উভচর, মাছ, পোকামাকড়—এরা সবাই নিজেদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য আশেপাশের পরিবেশের উপর নির্ভর করে।

এই কারণে, এদের শরীর ও আচরণে অনেক বিশেষ ধরনের অভ্যাস ও পরিবর্তন (adaptation) তৈরি হয়েছে।
এই প্রাণীদের সম্পর্কে জানলে আমরা বুঝতে পারি প্রকৃতির ভারসাম্য ঠিক রাখতে প্রতিটি প্রাণী কতটা গুরুত্বপূর্ণ।

Leave feedback about this

  • Quality
  • Price
  • Service

PROS

+
Add Field

CONS

+
Add Field
Choose Image
Choose Video